যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেক জালিয়াতি মামলার দুই আসামির সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ
প্রতিবেদক :
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেক জালিয়াতির মামলার দুই আসামির স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের (ফ্রিজ) আদেশ দিয়েছেন আদালত। তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আল আমিনের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার এই আদেশ দেন সিনিয়র স্পেশাল জজ (জেলা জজ) শেখ নাজমুল আলম। অভিযুক্ত দুজন হচ্ছেন যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চাকরিচ্যুত হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম ও প্রেস মালিক সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের শেখ মজিদ আলীর ছেলে শেখ শরিফুল ইসলাম। এ দুজনকে দুদক এ জালিয়াতি ঘটনার মূল অপরাধী বলে আখ্যায়িত করেছে। এ দুই জনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর দুদকের দায়ের করা মামলায় ৩৮টি চেক জালিয়াতি করে ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাড. মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, আদালত আসামিদের উল্লিখিত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন। আদালতের এই আদেশের নোটিস সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রার ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। যাতে আসামিরা সম্পত্তি বিক্রি এবং ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে না পারেন।
আদালতে দুদকের করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়, তদন্তকালে দেখা যায় মামলার ৩ নম্বর আসামি আব্দুস সালাম ও ৪ নম্বর আসামি শেখ শরিফুল ইসলাম এ মামলার মূল অপরাধী। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করে নিজে, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের নামে জায়গা জমি কিনে তার উপর অট্টালিকা নির্মাণ করেছেন। ঐ সম্পদ ক্রোক করা না হলে বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বর্ণিত স্থাবর সম্পদ জরুরিভিত্তিতে ক্রোক ও আলোচ্য মামলার সংযোগপ্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবসমূহ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা প্রয়োজন।
আবেদনে সম্পদের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে : আব্দুস সালামের যশোর হাউজিং এস্টেটের অধীন ই-বøক ১৪১ নম্বরের নির্মাণাধীন চারতলা বাড়ি। যার জমির মূল্য ৬০ হাজার ও নির্মাণাধীন বাড়ির মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যশোর শহরের বেজপাড়ায় আব্দুস সালামের স্ত্রী রিক্তা খাতুনের নামে দশমিক ৪৯৭ শতাংশ ও অপর আসামি শেখ শরিফুল ইসলামের নামে দশমিক ৪৯৭ শতাংশ জমি ও সেখানে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটবাড়ি। জমির মূল্য ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও নির্মাণাধীন দুই ফ্লাটের বিনিয়োগ মূল্য ৫০ লাখ টাকা। শেখ শরিফুল ইসলামের যশোর সদরের চাঁচড়া ইউনিয়নের ৫৯ নম্বর মাহিদিয়া মৌজার চার দাগের ৬৯ শতকের মধ্যে ২০ শতক জমি। যার মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। যশোর সদরের নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ১০৮ নম্বর বোলপুর মৌজার ২১২ ও ১৩৭৮ দাগের মোট ৮১ শতকের মধ্যে ওই আসামির ৬ শতক জমি রয়েছে। যার মূল্য ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
আরও বলা হয়েছে, আসামি শরিফুল ইসলামের যশোর শহরের দড়াটানা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের ২০টি শেয়ারের মধ্যে একটি যার আর্থিক পরিমাণ ১৪ লাখ টাকা রয়েছে। আসামি আব্দুস সালামের যশোরে সোনালী ব্যাংক বিআইএসই শাখায় একটি অ্যাকাউন্টে ২৬ হাজার ৮৫৯ টাকা, আসামি শরিফুল ইসলামের মিম প্রিন্টিং প্রেসের নামে অগ্রণী ব্যাংক দড়াটানা শাখায় একটি অ্যাকাউন্টে ৫ হাজার ৫৯ টাকা, মেসার্স খাজা প্রিন্টিং প্রেসের নামে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক যশোর শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ৫৪ হাজার ৭৭৪ টাকা, নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামে একই ব্যাংকের আরেকটি অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৯ টাকা, সবুজ প্রিন্টিং প্রেসের নামে দি প্রিমিয়ার ব্যাংক যশোর শাখায় একটি অ্যাকাউন্টে ২ হাজার টাকা, শরিফ প্রিন্টিং প্রেসের নামে একই ব্যাংকের আরেকটি অ্যাকাউন্টে ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকা, আশরাফুল আলমের শাহীলাল স্টোরের নামে ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৪২৩ টাকা, আব্দুস সালামের ছেলে শহিদুল ইসলামের নামে প্রাইম ব্যাংক যশোর শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৩৬৬ টাকা, শেখ শরিফুল ইসলামের মদিনা এন্টারপ্রাইজের নামে প্রাইম ব্যাংক যশোর শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ২৩ হাজার ১শ’ টাকা, সানিয়া ইলেক্ট্রনিক্সের নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে শূন্য টাকা, একই ব্যাংকে গাজী নুর ইসলামের নুর এন্টারপ্রাইজের নামে একটি অ্যাকাউন্টে শূন্য টাকা, রূপালী খাতুনের প্রত্যাশা প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি অ্যাকাউন্টে শূন্য টাকা, শরিফুল ইসলামের ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামে একটি অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৫৬৪ টাকা, একটি অ্যাকাউন্টে ১২ হাজার ২৫০ টাকা, একটি অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৬৪ হাজার ১৮৮ টাকা, একটি অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৯ হাজার ১২৫ টাকা, একটি অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৫ টাকা, একটি অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৯ হাজার ৩২৫ টাকা, একটি অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৫ টাকা, সনেক্স ইন্টারন্যাশনালের নামে একটি অ্যাকাউন্টে ৭ হাজার ৮৮১ টাকা, ল্যাপটপ মিউজিয়ামের নামে একটি অ্যাকাউন্টে শূন্য টাকা, শরিফুল ইসলামের নিজ নামে একটি অ্যাকাউন্টে ৫ হাজার ১৭৬ টাকা, এনআরবিসি ব্যাংক যশোর শাখায় শরিফুল ইসলামের ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামে একটি অ্যাকাউন্টে ২ হাজার ১২০ টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক যশোর শাখায় শরিফুল ইসলামের এস কে শরিফুল ইসলামের নামে একটি অ্যাকাউন্টে শূন্য টাকা ও ডাচ ব্যাংলা ব্যাংক যশোর শাখায় শরিফুল ইসলামের আইডিয়াল প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি অ্যাকাউন্টে ৪৩৭ টাকা রয়েছে।
উল্লেখ্য, দুদকের দায়ের করা চাঞ্চল্যকর ঐ মামলায় আব্দুস সালাম ও শেখ শরিফুল ইসলাম ছাড়াও যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমির হোসেন, তৎকালীন সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা ও যশোর নতুন উপশহর এলাকার হাইকোর্ট মোড় জামরুলতলার শাহীলাল স্টোরের মালিক আশরাফুল আলমকে আসামি করা হয়।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের ঐ আবেদনে ৩৮টি চেকের মাধ্যমে জালিয়াতির বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করা হয়, ২টি চেক সোনালী ব্যাংক বিআইএসই শাখা যশোর থেকে, ২টি চেক অগ্রণী ব্যাংক দড়াটানা যশোর শাখা থেকে মিম প্রিন্টিং প্রেসের নামে, তিনটি চেক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক যশোর শাখার মেসার্স খাজা প্রিন্টিং প্রেস ও নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামের হিসাবে, ২টি চেক দি প্রিমিয়ার ব্যাংক যশোর শাখার সবুজ প্রিন্টিং প্রেস ও শরীফ প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিংয়ের নামের হিসাবে, ২টি চেক ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার শাহী লাল স্টোরের নামের হিসাবে, ২৭টি চেক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক যশোর শাখার সানিয়া ইলেকট্রনিক্স, নুর এন্টারপ্রাইজ, প্রত্যাশা প্রিন্টিং প্রেস, ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিংয়ের নামে জমা হয়ে ক্লিয়ারিং হয়। এভাবে উল্লিখিত ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৮ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।