‘চলনশক্তিহীন’ সেই জ্যোতি’র এইচএসসিতেও সাফল্য
প্রতিবেদক :
এসএসসি’র ধারাবাহিকতায় ‘চলনশক্তিহীন’ সেই জ্যোতি হোসেন এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়েছেন। হুইলচেয়ারে করে কলেজে যাতায়াত আর শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে সাফল্য ছিনিয়ে নিয়েছেন অদম্য এই মেধাবী। আজ বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত ফলাফলে জ্যোতি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার সরকারি শহীদ মশিউর রহমান কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এই কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেন।
ঝিকরগাছা পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের পুরাতন কমিশনারপাড়া এলাকার মালয়েশিয়াপ্রবাসী কাদের হোসেন ও গৃহিনী রেক্সোনা হোসেনের দুই মেয়ের মধ্যে জ্যোতি বড়। পাঁচ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন জ্যোতি। মেরুদন্ডে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত কোনো শক্তি পান না তিনি। তাই হুইলচেয়ারই তার ভরসা। সেই হুইলচেয়ারে বসেই অদম্য মেধার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন তিনি। এর আগে জ্যোতি ২০২০ সালে ঝিকরগাছা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন।
জ্যোতির সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত মা রেক্সোনা হোসেন ফিরে যান শৈশবে। জ্যোতির তখন পাঁচ বছর বয়স। বেড়াতে গিয়ে ভ্যান থেকে পড়ে যায়। মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়ায় পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত শরীর একরকম অবশ ও অচল হয়ে যায়। ঢাকা, ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে তার চিকিৎসা করানো হয়। সর্বশেষ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপি’তে। সেখানে চিকিৎসা চললেও জ্যোতির হাত, পা বা শরীর একরকম প্যারলাইজড, অচল।
সেই থেকেই মেয়েকে নিয়ে সংগ্রাম শুরু রেক্সোনা হোসেনের। মেয়েকে ভর্তি করেন পারবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ৫ম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পান জ্যোতি। তার বাড়িতে ছুটে যান ঝিকরগাছা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক প্রয়াত লিয়াকত আলী ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন মুকুল। উদ্দেশ্য মেয়েটিকে পাইলট স্কুলে ভর্তি করানো। মেয়েকে পাইলট স্কুলে ভর্তির ইচ্ছে থাকলেও বাস্তবতা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রেক্সোনার সামনে। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব পাইলট স্কুলের। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি; পাঁচ বছর কিভাবে মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া করবেন! অগত্যা বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশে পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জ্যোতিকে ভর্তি করেন মা রেক্সোনা। এই স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেও জিপিএ-৫ ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। এ কারণে জ্যোতির ছোটবোন মেধাবী জেবা হোসেনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন রেক্সোনা। জেবাও তখন পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী।
ছোট মেয়ে জেবা ৮ম শ্রেণিতে উঠলে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাকে পাইলট স্কুলে ভর্তি করে দেন রেক্সোনা হোসেন। জ্যোতি তখন সবে ১০ম শ্রেণিতে উঠেছেন। জেবাকে স্কুলে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান। তিনি মা রেক্সোনা হোসেনকে জানিয়ে দেন, ছোট মেয়ে জেবাকে স্কুলে না পেলে বড় মেয়ে জ্যোতিকেও তিনি স্কুলে রাখবেন না। শিক্ষকের এহেন আচরণে অভিমানে কষ্টে বুক ভরে ওঠে রেক্সোনার। দ্বিধাগ্রস্ত রেক্সোনা তখন পাশে পান পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক লিয়াকত আলীকে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১০ম শ্রেণিতে জ্যোতিকে পাইলট স্কুলে ভর্তি করে নেন তিনি।
একবছর ধরে হুইলচেয়ারে করে প্রতিদিন এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ঠেলে নিয়ে স্কুলে গেছেন রেক্সোনা। বাড়িতে শিক্ষক রেখে মেয়েকে পড়িয়েছেন। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা চলনশক্তিহীন মেয়ের অবলম্বন হয়ে জয় করেন জিপিএ-৫।
এরপর তাকে ভর্তি করেন ঝিকরগাছার সরকারি শহীদ মশিউ রহমান কলেজ। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন জ্যোতি। কলেজের শিক্ষকরাও এগিয়ে আসেন। জ্যোতির জন্য তার ক্লাসগুলো ভবনের নিচতলায় নিয়ে আসা হয়। এরই মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাবে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে বাড়িতেই পড়াশোনা চালিয়ে যান।
এইচএসসির ফলাফলে খুশি জ্যোতি হোসেন জানান, লেখাপড়াই তার সবকিছু। নিয়মিত লেখাপড়া করে প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এসএসসিতে তার ছোট বোন হোসেন শ্রæতি লেখক ছিল। কিন্তু এবার জেবার এসএসসি পরীক্ষাসহ কিছু জটিলতায় তাকে শ্রুতি লেখক হিসেবে নিতে পারেনি। এইচএসসিতে তার শ্রুতি লেখক ছিল ঝিকরগাছা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী মরিয়ম খাতুন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে লেখাপড়া করলেও জ্যোতি তার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে অবগত। এজন্য তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে চান।
জ্যোতি হোসেনের মা রেক্সোনা হোসেন জানালেন, জ্যোতি এইচএসসি পাস করলেও তার ভবিষ্যত অনিশ্চিত। কোথায় কিভাবে ভর্তি করবেন; বা সে কিভাবে লেখাপড়া করবে এই নিয়ে চিন্তায় তার ঘুম আসে না।
তিনি আর বলেন, ডাক্তাররা বলেছিলেন, জ্যোতির নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে। সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপি’তে ছয় মাস পর পর তার নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু করোনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ফলে চিকিৎসাও একরকম বন্ধ হয়ে আছে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যদি চিকিৎসার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে আরেকটু সুস্থ করে দেন, তাহলে মেয়েটি দেশের সম্পদ হতে পারে।
সরকারি শহীদ মশিউর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ বিপ্লব কুমার সেন বলেন, ‘চলনশক্তিহীন’ জ্যোতি হোসেন অদম্য মেধাবী হওয়ায় তারা সবসময়ই মেয়েটির প্রতি আন্তরিক ছিলেন। তার ক্লাসগুলো সুবিধাজনক শ্রেণিকক্ষে নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পাশাপাশি তার সার্বিক বিষয়ে সবসময় খবর নিয়েছেন। মেয়েটির ফলাফলে তিনি খুশি।