Take a fresh look at your lifestyle.

পবিত্র আশুরার করণীয় বর্জনীয়

0

বিল্লাল বিন কাশেম :

আজ পবিত্র আশুরা। আশুরা আরবি শব্দ। এটি অর্থ দশম। শব্দটি হিজরি বর্ষের ১০ তারিখকে বুঝায়। হিজরি বছরের হিসেব মতে ৮ আগস্ট সোমবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় আশুরার শুভক্ষণ। যা মঙ্গলবার সন্ধ্যা তথা সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে আশুরা বলতে মহররম মাসের দশ তারিখকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। হিজরি পঞ্জিকার মহররম মাসের দশ তারিখে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন। এই কারণে মুসলমানরা যে শোক দিবস পালন করে থাকেন, তাকে আশুরা বলা হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে এ দিনটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। এরা মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে। মুসলমানদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন। আমলি মুসলমানগণ এ দিনটিতে রোজা ও তসবিহ তাহলিলের মাধ্যমে পালন করেন।

ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে অনন্য আশুরা। আশুরার অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ফজিলত আছে। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে : ১. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাতে এলেন তখন ইহুদিগণ আশুরার দিন রোজা রাখতেন। তারা জানাল, এ দিন মুসা (আ.) ফেরাউনের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। তখন মহানবি (সা.) তাঁর সাহাবীদের বললেন, মুসা (আ.) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার দিক থেকে তাদের চেয়ে তোমরাই অধিক হাকদার। কাজেই তোমরা (আশুরার দিন) রোজা রাখ।’ (বুখারি)

২. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) কাছে আশুরার দিন সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন, এই দিন জাহেলি যুগের লোকেরা রোজা রাখত।’ (মুসলিম)

৩. হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রাখতেন।’ (মুসলিম)

আসলে অনেক আমলি মুসলমানও জানেন না যে, আশুরার করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো। এ দিনটি রাসুল (সা.) কীভাবে পালন করতেন বা এদিন সম্পর্কে তিনি কী বলেছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনের প্রতিটি বছর আশুরার রোজা রাখতেন এবং সাহাবায়ে কেরাম এদিনে রোজা রাখতেন। আবার এদিনে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহের (সা.) ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির মহররম মাসের ১০ তারিখ কারবালার প্রান্তরে তাঁরই প্রাণপ্রিয় নাতি হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) বিপথগামী ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাৎ বরণ করেন।

তবে ইসলামের ইতিহাসে আশুরার ফজিলত কারবালার জন্য ফজিলতপূর্ণ নয়; কিংবা আশুরার কারণে হজরত ইমাম হুসাইন শাহাদাৎ বরণ করেছেন এমনটিও নয়; বরং ইয়াজিদ বাহিনীর অবৈধ রাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ইসলামি খেলাফতের পক্ষে কথা বলায় অন্যায়ভাবে নিরাপরাধ হজরত হুসাইন (রা.) কে পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ৭০ জন সঙ্গী-সাথীকে হত্যা করে।

আশুরায় করণীয়
১. আশুরার দিন রোজা রাখা : আশুরার দিন রোজা রাখলে এক বছরের সগিরাহ গোনাহ মাফের আশা করেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি। হাদিসের বর্ণনায় তা ওঠে এসেছে, হজরত আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আশুরার দিনের রোজার দ্বারা আমি আল্লাহর কাছে বিগত বছরের গুনাহ মাফের আশা রাখি।’ (মুসলিম, তিরমিজি)

আশুরার রোজা রাখার পদ্ধতিও ঘোষণা করেছেন আমাদের মহানবী। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখ; ইয়াহুদিদের মতো নয়; আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমাদ)

২. ক্ষমার ঘোষণা : আশুরার দিন ও মহররম মাসজুড়ে বেশি তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা এ দিন ও মাসের বিশেষ মুহূর্তে তাওবাহ-ইসতেগফারে আল্লাহ পুরো জাতিকে ক্ষমা করে দেবেন। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, মহররম হলো আল্লাহর কাছে একটি মর্যাদার মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)

৩. ত্যাগ ও কুরবানির শিক্ষা গ্রহণ : দ্বীন ও ইসলামের কল্যাণে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) জীবন থেকে আত্মত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করা সব মুসলমানের জন্য একান্ত করণীয়। যাদের মাঝে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর ঈমানি চেতনা জাগরিত হলেই ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয় আসবে।

৪. আশুরায় রোজাদারকে ইফতার করানো : এমনিতে ইফতার করানো অনেক ফজিলতপূর্ণ কাজ। সম্ভব হলে আশুরার দিনে নিজে রোজা রাখার পাশাপাশি রোজা পালনকারীদের ইফতার করানো উত্তম। সাধ্যমত দান-সাদাকাহ করা। গরিবদের পানাহার করানো। ইয়াতিমের প্রতি সদয় ব্যবহার ও সহযোগিতা করা।

আশুরায় বর্জনীয় :
১. হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) স্মরণে কাল্পনিক তাজিয়া বা নকল কবর বানানো থেকে বিরত থাকা।

২. তাজিয়া বানিয়ে তা কাঁধে বা যানবাহনে বহন করে মিছিলসহ সড়ক প্রদক্ষিণ করা থেকেও বিরত থাকা।

৩. নকল এসব তাজিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকা এবং এসব তাজিয়া বা নকল কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ দান করা থেকেও বিরত থাকা।

৪. নিজেদের দেহে আঘাত বা রক্তাক্ত করা থেকে বিরত থাকা।

৫. শোক বা মাতম করা থেকে বিরত থাকা।

৬. যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা থেকে বিরত থাকা।

৭. হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে বিলাপ, মাতম কিংবা মর্সিয়া ও শোকগাঁথা প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বুকে পেটে পিঠে ছুরি মেরে রক্তাক্ত করা থেকেও বিরত থাকা।

৮. ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের বাদ্যযন্ত্রের তালে প্রদর্শনী থেকে বিরত থাকা।

৯. হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) নামে ছোট বাচ্চাদের ভিক্ষুক বানিয়ে ভিক্ষা করানো। এটা করিয়ে মনে করা যে, ঐ বাচ্চা দীর্ঘায়ু হবে। এটাও মহররম বিষয়ক এক কু-প্রথাও বটে।

১০. আশুরায় শোক প্রকাশের জন্য নির্ধারিত কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরা থেকে বিরত থাকা।

১১. আশুরা বা ১০ মহররমকে কেন্দ্র করে এসব প্রচারণা থেকে বিরত থাকা জরুরি : ক. ১০ মহররম পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়। খ. কেয়ামত সংঘটিত হওয়া। গ. হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) সৃষ্টি। বেহেশতে প্রবেশ। আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হওয়া। ঘ. হজরত ইবরাহিম (আ.) আগুন থেকে নাজাত। ঙ. হজরত নুহ (আ.) কে মহাপ্লাবন থেকে নিষ্কৃতি ও পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস। চ. এই দিনেই অত্যাচারী শাসক নমরূদের ধ্বংস। উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে আশুরার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং মিথ্যা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহান্নামে নিজেদের ঠিকানা বানানো থেকে বিরত থাকাই জরুরি।

আমাদের মহান রব মুসলিম উম্মাহকে আশুরার ফজিলত পেতে এর করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তৌফিক দান করুন। এর বর্জনীয় ও মিথ্যা ঘটনা বর্ণনা থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ আমাদের কোরআান ও হাদিসের আলোকে যথাযথ আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন

লেখক : উপপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

Leave A Reply

Your email address will not be published.