শব্দশিল্পী ফখরে আলম
ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল: সত্যিকার অর্থেই তিনি শব্দের শিল্পী ছিলেন। শব্দ নিয়েই তিনি খেলা করতেন। শব্দ নিয়ে গান গাইতেন। তার শব্দের গানেরা হয়ে উঠত একেকটি প্রাণবন্ত প্রতিবেদন। অনবদ্য রিপোর্ট। রিপোর্ট তো নয় যেন নিউজের গল্প। গল্পকথার রিপোর্ট। পাঠকেরা প্রাণভরে সে রিপোর্ট পড়তেন। আসলে রিপোর্টকে একটি শৈল্পিক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নিজস্ব একটি ঢং-ই তার সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিজস্ব এমন ধারার ঘটনা অন্য আর দশটি রিপোর্ট বা দশজন সাংবাদিক থেকে তাকে স্বাতন্ত্র্য একটি অবস্থানে নিয়ে যায়।
অবশ্য তার এই স্বাতন্ত্র্যধারার জন্য অনেক বিদ্রুপ মন্তব্যও তাকে শুনতে হয়েছে। সাংবাদিকতার রীতিবিরুদ্ধ সমালোচনায় তিনি সবসময় আলোচিত ছিলেন পেশাদার মহলে। তবে আলোচনা-সমালোচনা যাই থাকুক না কেন, তিনি যে তার রাজ্যের একচ্ছত্র রাজা, বার বার তার প্রমাণ দিয়েছেন। এজন্য সাংবাদিকতায় ধারাবাহিক সাফল্য লাভ করেছেন। সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতার সাধক ছিলেন তিনি। এর প্রতিদানও পেয়েছেন তিনি। একজন জেলা সাংবাদিকের প্রধানসারির একটি দৈনিকের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে ওঠা, তার সেই কৃতিত্বেরই স্বাক্ষর বহন করে। জেলা শহরে সাংবাদিকতা করে রিপোর্টিং-এর সর্বোচ্চ অবস্থানে যাওয়া বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসেও নজিরবিহীন। ১৪ মে ২০২০ সালে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন।
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ফখরে আলম ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তিনি ভারতের টাটা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলেন। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল ক্যান্সারের কারণে তিনি দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু দৃষ্টি হারানোর পরও দমে যাননি তিনি। অন্তঃচোখ দিয়ে তিনি অনেক কিছুই দেখতেন। আর সেই দেখাকে সহযোগীর সহযোগিতায় লেখা কিংবা রিপোর্টের আদলে রুপ দিতেন।
সাংবাদিকতার আগে অবশ্য তার লেখালেখির সূচনা হয় কবিতায়। কবি হিসেবেও তার সুখ্যাতি ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে তিনিই একমাত্র কবি যিনি যশোরের আঞ্চলিক কথাকে শব্দের শিকলে বন্দী করতে পারতেন। তার শব্দের খেলা পাঠক আর খোলা মাঠের অনুষ্ঠানের দর্শককে ভীষণভাবে আলোড়িত করত।
সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল একজন মানুষ। যশোর সাহিত্য পরিষদকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। স্বৈরাচার, জঙ্গিবাদ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ধারাবাহিক। যশোর শহরের চাঁচড়া শংকরপুর এলাকায় যে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছে, তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
ফখরে আলম একজন বৃক্ষপ্রেমিক। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ফুলের বাগান করে আসছেন। নিজস্ব একটি ভিন্ন ধরনের গাছের সংগ্রহশালা রয়েছে তার। সেখানে ক্যাকটাস, অর্কিড, বনসাইসহ দেশ- বিদেশের নানা প্রজাতির ফুল ফলের গাছ রয়েছে। তিনি গাছের চারার কলম তৈরি করে অনেককে উপহার দিয়েছেন। সাংবাদিকতা ও বৃক্ষরোপনে দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। কবিতা আর সাংবাদিকতা নিয়ে তিনি লিখেছেন বই। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ থেকে নানান ধরনের সংবাদের বৈচিত্র্যে ঠাসা লেখা নিয়ে একের পর এক বই বেরিয়েছে তার। ফখরে আলমের প্রকাশিত গ্রন্থ ৩৮টি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআইয়ের আওতায় জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য তিনি ২০১৬ সালে ‘নানা রঙের ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ের যশোর জেলা’ শ্লোগানটি রচনা করেন। এই শ্লোগানের ভিত্তিতে দেশ-বিদেশে যশোরকে তুলে ধরা হচ্ছে।